পবিত্র কুরআন নাযিলের ইতিহাস ও তাৎপর্য
‘করুণাময় আল্লাহ্। শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা। সূর্য ও চন্দ্র হিসাব মতো চলে এবং তৃণলতা ও বৃক্ষাদি সেজদারত আছে। তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড, যাতে তোমরা সীমালঙ্ঘন না করো তুলাদণ্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না।’ (সূরা রাহমান : ১-৯)
মহান আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টির কথা বলার আগে জানিয়েছেন তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর এ কুরআন আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাজিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে আসা।’ (সূরা ইউনূস : ৩৭)
এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানব সৃষ্টির আসল লক্ষ্যই হচ্ছে কুরআন শিক্ষা এবং কুরআন নির্দেশিত পথে চলা। আল্লাহ কুরআনে আরো বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে শুধু আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ আবার বলা হয়েছে স্রষ্টা হিসেবে মানুষের পথ-প্রদর্শনের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর নিজের। সুতরাং,আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআন শিক্ষা দেয়া শুধু তাঁর অনুগ্রহ নয় বরং তাঁর স্রষ্টা হওয়ার স্বাভাবিক দাবি। পুরো বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পর তিনি সব কিছু এমনিতেই ছেড়ে দেননি বরং সবকিছুতে আকার আকৃতি দান করেছেন যাতে প্রকৃতিগতভাবে নিজেই নিজের চলার পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারে। মানুষের নিজ দেহের এক একটি লোম এবং এক একটি কোষকে মানবদেহের কাজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দেয়ার মাধ্যমেই জন্ম লাভ হয়েছে। তাই মানুষ নিজের ইচ্ছায় কখনো প্রকৃতিগত সঠিক পথ থেকে মুক্ত হতে পারে না।
সূরা নাহলে বলা হয়েছে, ‘সরল সোজা পথ দেখিয়ে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব। বাঁকা পথের সংখ্যা তো অনেক। সূরা ত্ব-হায় উল্লেখ আছে যে, ফেরাউন মুসা আ:-এর মুখে রিসালাতের পয়গাম শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার সেই রব কে যে আমার কাছে দূত পাঠায়? জবাবে হজরত মুসা আ: বললেন : ‘তিনিই আমার রব যিনি প্রতিটি জিনিসকে একটি নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি দান করে পথপ্রদর্শন করেছেন।’ অর্থাৎ, মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী রাসূল ও আসমানী কিতাবসমূহ নাজিল প্রকৃতিরই দাবি।
মানব সৃষ্টির পর অসংখ্য নেয়ামত মানুষকে দান করা হয়েছে। এসব অবদানের মধ্যে ভাষা শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তাৎপর্যগতভাবে, ভাষা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মানুষের ক্রমবিকাশের সাথে যেসব বিষয় সম্পর্কযুক্ত যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মধ্যে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিক্ষা। এই শিক্ষার মধ্যে প্রথমে কুরআন শিক্ষা ও পরে ভাষা শিক্ষার কথা এসেছে। কারণ কুরআন শিক্ষা তখনই সম্ভব যখন ভাষা অর্জন সম্ভব হবে। ভাষা শিক্ষার দুটি দিকের মধ্যে একটি হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা এবং অপরটি হচ্ছে কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
এখানে ভালোমন্দ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও কল্যাণ অকল্যাণ সম্পর্কে জ্ঞ এর সাথে সাথে আরো একটি গুণ মানুষকে দান করা হয়েছে। তা হচ্ছে গড়ৎধষ ংবহংব বা নৈতিক অনুভূতি। এই বৈশিষ্ট্যগত গুণের জন্য মানুষ ভালো ও মন্দ, জুলুম ও ইনসাফ এবং উচিত ও অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করে এবং চরম গোমরাহি ও অন্ধকার যুগেও এই নৈতিক শিক্ষা লোপ পায় না। মৌখিক ভাষা, লেখা ও চিঠির মাধ্যমে ভাষা শিক্ষা এবং অপরকে বুঝানোর যত দিক রয়েছে সবই এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। জাতি ও গোষ্ঠী ভেদে এবং আঞ্চলিক দিক থেকে যে যেই ভাষা বা মাধ্যমেই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম সবই এই আল্লাহর ভাষা শিক্ষাদানের আয়াতের মধ্যে নিহিত। সুতরাং, আধুনিকতার ছড়াছড়িতে বই, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও ধর্মীয় শিক্ষা লেখা বিতর্ক ও যুক্তি সবই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ধরা হলেও স্রষ্টার শিখিয়ে দেয়া শিক্ষাকে যথেষ্ট মনে করা হয় না। অথচ, নবী-রাসূলদের জন্য বিশেষ কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও কুরআনের মাধ্যমেই তাঁরা যুগে যুগে সঠিক পথের আলোর দিশার জ্ঞান বিলিয়ে গেছেন। অবশেষে এটাই প্রতীয়মান যে, একমাত্র কুরআন শিক্ষা করাই মানুষের মূল উদ্দেশ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাষা শিক্ষা অর্জন।
‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড, যাতে তোমরা সীমালঙ্ঘন না কর তুলাদণ্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না।’ এই অংশে কুরআন নাজিলের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে। সূর্য চন্দ্র তৃণলতা ও বৃক্ষরাজিসহ এ বিশ্বলোকে বিদ্যমান অসংখ্য সৃষ্টি ও বস্তুরাজির যদি পূর্ণমাত্রার সুবিচার ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা না হতো তাহলে এ জগত এক মুহূর্তের জন্যও চলতে পারত না। সুতরাং, মানুষের আবাসস্থল যেহেতু পরিপূর্ণ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেহেতু মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষকে যেসব স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেখানে যদি বেইনসাফি করে এবং পরিপূর্ণ হক আদায় না করে তবে তা হবে বিশ্বপ্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। এ মহাবিশ্বের প্রকৃতি জুলুম, বেইনসাফি ও অধিকার হরণে বিশ্বাসী না। কুরআনের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে তাওহিদ এবং দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে সুবিচার ও ইনসাফ। অবশেষে এ কথাই স্পষ্ট যে, রহমান আল্লাহ্ পথপ্রদর্শনের জন্য কুরআন পাঠিয়েছেন এবং মানবজাতির জন্য শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন।
লেখিকা : গবেষক